বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ম্রো সম্প্রদায়ের পুরো একটা পাড়াকে জিম্মি করে প্রাকৃতিক বন উজাড় করা হচ্ছে৷ অভিযোগের আঙুল এক আওয়ামী লী...
বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ম্রো সম্প্রদায়ের পুরো একটা পাড়াকে জিম্মি করে প্রাকৃতিক বন উজাড় করা হচ্ছে৷ অভিযোগের আঙুল এক আওয়ামী লীগ নেতার ভাইয়ের দিকে৷
প্রায় দুই দশক ধরে এই বন থেকে গাছ কেটে নিচ্ছেন তিনি৷ কেউ বাধা দিতে গেলে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়৷ অস্ত্র প্রদর্শন করা হয়৷
পাহাড় থেকে হাতি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় গাছের গুড়ি৷
হাতির বিষ্ঠায় ছড়াগুলোর পানি দূষিত হয়ে যায়৷ বিশুদ্ধ পানির সংকটে পড়েন স্থানীয় ম্রো-রা৷ দূষিত জল খেয়ে কয়েকজন স্কুল ছাত্রের ইতিমধ্যে ডায়রিয়া হয়েছে৷
বান্দরবন জেলা শহর থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূরে সুয়ালক-লামা সড়কের পাশে সরই ইউনিয়ন৷ সরইয়ের কেয়াজু বাজার থেকে ১২ কিলোমিটার পূর্বে এই লেমুপালং মৌজার অবস্থান৷ সরই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে এটি৷ সম্প্রতি ওই এলাকা ঘুরে এসে রিপোর্ট করেছেন বিডিনিউজ টরয়েন্টিফোর ডটকমের বান্দরবান প্রতিনিধি উসিথোয়াই মারমা৷ তিনি বলেন- "আমি লামা ঘুরতে গিয়েছিলাম৷ যখন ফিরে আসি, তখন স্থানীয় কয়েকজন যুবক আমাকে বলেন, হতির বিষ্ঠায় খাওয়ার পানির ছড়াগুলো দূষিত হচ্ছে৷ ৪ জন শিক্ষার্থী ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে৷ এটা যেন আমি প্রশাসনের দৃষ্টিতে আনি৷ সেই সূত্র ধরেই আমি সেখানে গিয়ে অবৈধভাবে বন উজাড় করার তথ্য পেয়েছি৷ আমার সঙ্গে যখন ম্রো সম্প্রদায়ের লোকজন কথা বলছিলেন, তখন তাদের চোখে-মুখে ভয় আর আতঙ্কের ছাপ দেখেছি৷ তারা বলেছেন, এ নিয়ে রিপোর্ট হলে তাদের উপর নির্যাতন হতে পারে৷ তবে ঈদের ছুটি শেষ না হওয়ায় আমি সেখানে গিয়ে শ্রমিকদের কাউকে পাইনি৷ শুধু একজন মাহুতের সহকারীকে পেয়েছি৷ হাতিটিও আমি দেখেছি৷ পানি দূষিত হওয়ার বিষয়টিও আমি দেখেছি৷”
সরই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মেন ওয়াই ম্রো বলেন- "দুই দশকের বেশি সময় ধরে এখান থেকে গাছ কেটে নিচ্ছেন চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার মোরশেদ আলম চৌধুরী৷ ২০১৫ সালে আমরা কয়েকজন তাদের এই কাজে বাধা দিয়েছিলাম৷ গাছ কাটায় বাধা দেওয়ার পর আমাদের তিন জনের বিরুদ্ধে অপহরণ, হত্যাচেষ্টা ও মাদকের তিনটি মামলা দেওয়া হয়৷ ফলে এরপর আর কেউ বাধা দেওয়ার সাহস করেনি৷ পাঁচ বছর মামলা চালানোর পর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ২০২০ সালে মামলা খারিজ হয়ে যায়৷ আসলে আমাদের এলাকার অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর ও জুমচাষি৷ কোথাও অভিযোগ করলে হয়রানি ও মামলার ভয়ে কেউ কিছু বলেন না৷ কোথাও অভিযোগ দিয়েছি শুনলে আমাদের উপর চাপ বাড়ে৷”
মোরশেদ আলম চৌধুরী চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবলীগের কমিটির সদস্য৷ বর্তমানে তিনি ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে আছেন৷ তার বড় ভাই লোহাগড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খোরশেদ আলম চৌধুরী বলেন- "আমার ভাই দীর্ঘদিন ধরে কাঠের ব্যবসা করেন৷ যে জায়গা থেকে গাছ কাটার কথা বলা হচ্ছে, তার পাশে আর্মি ক্যাম্প, পুলিশ ক্যাম্প আছে৷ অনুমতি না থাকলে কি তিনি ওখান থেকে গাছ কেটে আনতে পারবেন? আমি বিষয়গুলো পুরোপুরি জানি না৷ তিনি দেশে এলেই বিষয়টি জানা যাবে৷ তবে আমি যতটুকু জানি, বন বিভাগের অনুমতি নিয়েই তিনি এতদিন ধরে কাঠের ব্যবসা করে আসছেন৷”
তবে এমন অনুমতির কথা অস্বীকার করেছেন লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আরিফুল হক বেলাল৷ তিনি বলেন- "আমার জানা মতে, এমন কোনো অনুমতি কাউকে দেওয়া হয়নি৷ পাশাপাশি হাতি ব্যবহার করে কাঠ টানতে হলেও বন বিভাগের অনুমতি লাগে৷ সেই অনুমতিও আমরা দিইনি৷ বিষয়টি জানার পর আমি একটি তদন্ত কমিটি করেছি৷ নিরাপত্তার কারণে তারা এখনো ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে পারেনি৷ তবে দু-এক দিনের মধ্যেই তারা সেখানে যাবেন৷ বিষয়টি দেখে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেবো৷”
সার্ক মানবাধিকার ফোরামের সহ-সভাপতি অং ম চং বলেন- "সংরক্ষিত এই বনম্রো সম্প্রদায়ের জীবন ধারণের মাধ্যম৷ এখন তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন যদি অবৈধভাবে কেটে নেওয়া হয়, তাহলে কি হবে? আমি চাই প্রশাসন দ্রুত এ ব্যাপারে পদেক্ষপ নিক৷ তিনি যত বড় নেতাই হোন না কেন, দ্রুত তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই৷”
জানা গেছে- লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের লেমুপালং মৌজায় ১৩টি ম্রো পাড়া রয়েছে৷ বান্দরবান হেডম্যান-কারবারি কল্যাণ পরিষদের সভাপতি ও বেতছড়া মৌজার হেডম্যান হা থোয়াই হৃ মারমা বলেন- "আমাদের এখানে পাড়াবন বা গাছ বিক্রির কোনো বিধি-বিধান নেই৷ প্রচলিত বিধি অনুযায়ী, হেডম্যান মৌজারবনের সম্পদ ও ভূমি সংরক্ষণ করেন৷ কোনো হেডম্যান চাইলে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে মৌজার বন বিক্রি করে দিতে পারেন না৷ প্রথাগত বিধিতে এটা কোথাও নেই৷ কেউ যদি না জেনে করে থাকেন তা-ও সম্পূর্ণ অবৈধ৷”
যত বড় নেতাই হোন ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই: অং ম চং
মোরশেদ আলম চৌধুরীর লোকজনের দাবি- জোত-পারমিটের মাধ্যমে মৌজাপ্রধান হেডম্যানের কাছ থেকে ওই বাগান কেনা হয়েছে এবং বৈধভাবেই গাছ কাটা এবং হাতি দিয়ে সেই গাছ-কাটা কাঠ টানা হচ্ছে৷ একসময় লেমুপালং মৌজার হেডম্যান ছিলেন চন্দু ম্রো৷ তিনি নিরক্ষর ছিলেন৷ বলা হচ্ছে, তার কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়ে সারা জীবনের জন্য এই চুক্তিপত্র তৈরি করা হয়েছে৷
এই মৌজার হেডম্যান চন্দু ম্রোর ছেলে কাইন ওয়াই ম্রো বলেন- "বনের গাছ না কাটার জন্য মোরশেদের লোকজনকে নিষেধ করা হলেও তারা আমার বাবার সঙ্গে একটা চুক্তির কথা বলে৷ কিন্তু কী চুক্তি, কত বছরের চুক্তি আমি বা আমরা কিছুই জানি না৷ আমরা অনেকবার তাদের নিষেধ করেছি৷ কিন্তু তারা আমাদের কথা শোনেন না৷”
পুরাতন দেওয়ান পাড়া, নতুন দেওয়ান পাড়া এবং বাক্কা পাড়ার মাঝখানে একটি স্কুল গড়ে তোলা হয়েছে৷ এই স্কুলের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটি ঝিরি৷ এদিকে এই কাঠ বহনের জন্য আনা হয়েছে হাতি৷ সেই হাতির বিষ্ঠায় ঝিরির পানি দূষিত হয়ে গেছে৷ স্কুলের শিক্ষার্থী ও আশপাশের পাহাড়িদের খাওয়ার পানির উৎস এই ঝিরি৷ দুই সপ্তাহ আগে গরমের মধ্যে চার শিক্ষার্থী সেই ঝিরির পানি পান করে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে৷
স্কুলের শিক্ষক থোংয়া ম্রো বলেন- "আমাদের স্কুলটি তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত৷ ফলে ছোট বাচ্চারা এখানে আসে৷ আমরা দেখি, ঝিরি দিয়ে হাতির পিঠে করে কাঠ নেওয়া হয়৷ আমরা বাচ্চাদের নিষেধ করেছি ঝিরির পানি খেতে৷” যারা হাতি দিয়ে কাঠ নিচ্ছে তাদের কি এই ঝিরি দিয়ে না নেওয়ার কথা বলেছেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "তারা ক্ষমতাশালী লোক৷ তাদের এসব বলে আমরা আবার কী বিপদে পড়ি, তাই কিছু বলিনি৷”
লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোস্তফা জাবেদ কায়সার বলেন- "গাছ কাটা ও ঝিরির পানি দূষিত হওয়ার বিষয়টি আমরা জেনেছি৷ এ নিয়ে বন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে৷ তাদের একটি রিপোর্ট দিতে বলেছি৷ তাদের রিপোর্ট পাওয়ার পর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷”
No comments
আপনার কমেন্টের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ!